ম্যানগ্রোভ ও ম্যানের বেঁচে থাকার আন্তর্জাতিক লড়াই।

26th July 2020 9:12 pm উত্তরবঙ্গ
ম্যানগ্রোভ ও ম্যানের বেঁচে থাকার আন্তর্জাতিক লড়াই।


ম্যানগ্রোভ ও ম্যানের বেঁচে থাকার এক আন্তর্জাতিক লড়াই। 

আজ ২৬ জুলাই আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবস। ম্যানগ্রোভ বা বাদাবনের জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ন রাখা এবং এর প্রতিবেশ সুরক্ষার আহ্বান জানিয়ে এ বছর দিবসটি পালিত হচ্ছে।

ইকুয়েডরে ম্যানগ্রোভ কেটে চিংড়ি চাষ করার প্রতিবাদে ১৯৯৮ সালের ২৬ জুলাই আয়োজিত সমাবেশে একজন অংশগ্রহণকারীর মৃত্যু হয়। সেই থেকে তাঁর স্মরণে এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘ দিবসটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, পৃথিবীতে ১,৮১,০০০ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বিস্তৃত ছিল। কিন্তু অতি সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, এ বনাঞ্চলের আয়তন ১,৫০,০০০ বর্গ কি.মি. এর নিচে নেমে এসেছে। সমগ্র পৃথিবীর উপকূলীয় আবাসস্থল অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে জর্জরিত। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল হতে অতিরিক্ত কাঠ ও মাছ আহরণের ফলে এবং উপকূলীয় ভূমিকে বিকল্প ব্যবহার যোগ্য ভূমি হিসেবে ব্যবহারের ফলে এ বনাঞ্চল হুমকির সম্মুখীন।

সারা পৃথিবী ব্যাপী গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের উষ্ণ ও উপউষ্ণ (Tropical and Sub-tropical) উপকূলীয় এলাকায় ম্যানগ্রোভ জাতীয় বনাঞ্চল দেখা যায়। পৃথিবীতে ১০২টি দেশে ম্যানগ্রোভের অস্তিত্ব থাকলেও কেবলমাত্র ১০টি দেশে ৫০০০ বর্গ কি.মি. এর বেশি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রয়েছে। পৃথিবীর সমগ্র ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ৪৩% ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া এবং নাইজার এ অবস্থিত এবং এদের প্রত্যেকটি দেশে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ২৫% হতে ৬০% ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রয়েছে।

বাংলাদেশে অবস্থিত ম্যানগ্রোভ বন (সুন্দরবন) পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে পরিচিত। সুন্দরবন বিশ্বের অন্যান্য ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের থেকে বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলেমিটার জায়গাজুড়ে এ বন বিস্তৃত। বাংলাদেশ অংশের আয়তন প্রায় ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার।

ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট কীঃ 
ম্যানগ্রোভ হচ্ছে বিশেষ এক ধরনের উদ্ভিদ যা সাধারণত সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে লবণাক্ত জলে জন্মায়। ম্যানগ্রোভ এর বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় লবণাক্ত অম্ল জলে জন্মানো উদ্ভিদ৷ ম্যানগ্রোভ গাছের সাধারনত ২ টি বৈশিষ্ট্য থাকে।
• শ্বাসমূলঃ ছড়ানো মূল তন্ত্রের উদ্ধমুখি শাখা জলের উপর জেগে থাকে এবং এর ডগায় নিউমাটাপোর নামে শ্বাস ছিদ্র থাকে।
• জরায়ুজ প্রজননঃ এদের বীজ খসার আগেই ফলের মধ্যে অঙ্কুরিত হয়ে থাকে।
 মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই শিকড় গেঁথে মূল বিস্তার করতে পারে। সারা পৃথিবীর সমস্ত ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের ৪৩ ভাগ ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, এবং নাইজারে অবস্থিত। সুন্দরবন হচ্ছে বিশ্বের সবচাইতে বড় ম্যানগ্রোভ বন।
 ইউনেস্কো সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করে।  সুন্দরবনকে আবার  প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য ও বলা হয়। ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের গাছগুলোর  অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জোয়ারের সময় শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে এই গাছের শিকড় গুলি মাটি ফুঁড়ে উপরে উঠে যায় এজন্য একে শ্বাসমূলও বলে । ম্যানগ্রোভ মূলত  জোয়ার ভাটা বিধৌত লবণাক্ত সমতল ভূমি যেখানে পারস্পরিক নির্ভরশীল বিভিন্ন স্তরের উপাদানগুলো একসাথে থাকে।  এই ম্যানগ্রোভের মূল ভিত্তি হচ্ছে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ গুলি।
 সারা পৃথিবীতে প্রায় ১ লাখ ৮১ হাজার ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ছিল। কিন্তু বর্তমানে প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার বর্গকিলোমিটারের নিচে নেমে এসেছে। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের জীববৈচিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এদের অনেক প্রজাতি ম্যানগ্রোভ কে তাদের জীবন চক্রের কোন না কোন সময় ব্যবহার করে থাকে। তাছাড়া পরিবেশের ইকোসিস্টেমের সাথে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের গভীর ও নিবিড় সাংস্কৃতিক অবস্থান এবং পরস্পপর নির্ভরশীলতা রয়েছে। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল মূলত, প্রাকৃতিক পুনঃ উৎপাদনশীল একটি ইকোসিস্টেম যেটা উপকূলীয় এলাকার জনগোষ্ঠী ও তাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্য এবং সেবার অন্যতম উৎস। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের গাছগুলি মাটিকে অনেক শক্তভাবে ধরে রাখে এবং এদের শিকড় মাটির অনেক গভীরে প্রোথিত হয়। 

কোথায় গড়ে উঠে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট?

সারা পৃথিবীর গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের উষ্ণ ও উপ উষ্ণ উপকূলীয় এলাকায় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট দেখা যায়।  সাধারণত ৩০০ উত্তর ৩০০ দক্ষিণ অক্ষাংশের বরাবর ম্যানগ্রোভ বনের অস্তিত্ব বেশি পাওয়া যায়। ম্যানগ্রোভ গাছ ১০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।  কিন্তু অতিরিক্ত ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারেনা। এছাড়া তুষার ও বরফ সহ্য করতে পারে না। ম্যানগ্রোভ গাছ জন্মানোর সবচাইতে উপযোগী অঞ্চলগুলি হচ্ছে আদ্র ক্রান্তীয় অঞ্চল। যেমন গঙ্গা, মেকং, আমাজনের উপকূলবর্তী বদ্বীপ এলাকাসমূহ।  সারা পৃথিবীর মোট ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ৪৩% ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, নাইজারে অবস্থিত। 
 বাংলাদেশের সুন্দরবন পৃথিবীর সবচাইতে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল নামে পরিচিত।  ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল  সমুদ্র নদীর তীর দ্রুত প্লাবিত হয়  এমন নোনাপানি বিধৌত অঞ্চলে বেশি হয়ে থাকে।  বাংলাদেশ ও ভারতে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র মেঘনার  পাড়ে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল অবস্থিত।  গাছ গুলোর মধ্যে বেশিরভাগ হচ্ছে সুন্দরী কেওড়া গরান  অন্যান্য  গাছ।  উত্তর আমেরিকার ফ্লোরিডায়, দক্ষিণ আফ্রিকায়, অস্ট্রেলিয়ায় এবং জাপানে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল লেখা দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া ব্রাজিল মেক্সিকো কিউবায় ম্যানগ্রোভ বনের অস্তিত্ব বহুলাংশে দেখতে পাওয়া যায়।

ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট এর উপকারিতা

ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল থেকে  আমরা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অনেক উপকার পেয়ে  থাকি।  ম্যানগ্রোভ বন উপকূলীয় এলাকাকে় বন্যা জলোচ্ছ্বাস ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে।  ম্যানগ্রোভ বন সাধারণত বিনা খরচেই উৎপাদিত হয় কিন্তু এর বাণিজ্যিক মূল্য অনেক। ম্যানগ্রোভ বন ইকোসিস্টেমের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে অনেক প্রাণী এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।  উপকূলীয় এলাকার লোকজন, যেখানে ম্যানগ্রোভ বন আছে তারা সাধারণত ম্যানগ্রোভ বনের উপর নির্ভর করেই তাদের জীবিকা অর্জন করে। যেমন সুন্দরবন থেকে জেলেরা মাছ সংগ্রহ করে,  মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ করে এবং  গাছের কাঠ বিক্রি করে কাঠুরেরা। এছাড়াও সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রাণী ও অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে বাংলাদেশ সরকার ও সুন্দরবন তীরের মানুষগুলি তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।

ম্যানগ্রোভ বনের গাছ গুলি দুষণ থেকে পরিবেশকে রক্ষা করতে সক্ষম। এই গাছগুলি জলকে পরিষ্কার করে এবং বন্যপ্রাণীর খাদ্যের যোগান দেয়। যেমন ২০০৫ সালের সুনামীতে আমরা দেখতে পাই যেসব এলাকায় ম্যানগ্রোভ বন বেশি ছিল সেসব এলাকার লোকজন জলোচ্ছ্বাস এবং জলের তীব্রতার শিকার হয়নি। এছাড়া ম্যানগ্রোভ বন কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে পশু এবং পাখিদের আবাস।  আবার মাছ এবং অন্যান্য প্রাণীরা মিলে ম্যানগ্রোভ বন এবং পরিবেশের সাথে একটা সুন্দর আবহাওয়া তৈরি করে।
  এছাড়াও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের সৌন্দর্যের কারণে অনেক পর্যটক ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল দেখতে  আসে।  ম্যানগ্রোভ বন গুলি আমাদের কাগজ সুতা আসবাবপত্র জামাকাপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্রের কাঁচামালের যোগান দেয়। এছাড়াও মধু এবং মোম থেকে সংগ্রহকারীরা  পয়সা উপার্জন করে।  অস্ট্রেলিয়া এবং শ্রীলংকার আদিবাসীরা ম্যানগ্রোভ বন থেকে তাদের জীবন ধারনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করে।  ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল আমাদের  বৃহত্তর পরিমাণে  অক্সিজেনের যোগান দেয়।

বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট হচ্ছে  সুন্দরবন।  হাজার ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে  সুন্দরবনকে  স্বীকৃতি দেয়।  সুন্দরবনের মোট দৈর্ঘ্য ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য ৬০১৭ বর্গ কিলোমিটার  এবং বাকি অংশ ভারতে অবস্থিত।  সুন্দরবনের রয়েছে অনেক পরিমাণে সুন্দরী, গেওয়া, গরান এবং কেওড়া গাছ আছে। এছাড়া প্রায় তিন শতাধিক প্রজাতির গাছ রয়েছে সুন্দরবনের। সুন্দরবনের রয়েছে আড়াই শতাধিক প্রজাতির পাখি এবং ২১৪ প্রজাতির সরীসৃপ এবং বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও অন্যান্য মাছ। এছাড়া সুন্দরবনের রয়েছে অজগর গুইসাপ গোখরো সাপ রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং অন্যান্য সব সুন্দর প্রাণী। 

হুমকির মুখে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট এর অস্তিত্ব আমাদের করণীয়

সুন্দরবনের সুন্দরী গাছগুলো আগামী ২০  বছরে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সঠিকভাবে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করার উদ্যোগের অভাব এবং সমুদ্র উপকূলের লবণাক্ততা  তীব্রভাবে বৃদ্ধি।  এছাড়া বিশ্বব্যাপী বন উজাড় করার কারণে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল গুলি ধ্বংসের মুখে ও হুমকির মুখে পড়েছে।  যদি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলগুলিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পায় তাহলে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল গুলির উপর নির্ভর করে যেসব প্রাণী বেঁচে থাকে সেসব প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে যাবে।  এছাড়া ম্যানগ্রোভ গাছগুলোর গোড়ায় বালু জমে গাছগুলি মরে যায়।  উপকূলীয় এলাকায় ভাঙ্গন, নিজেদের ইচ্ছেমত   বনের কাঠ বিক্রি করে দেওয়া ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ধ্বংসের অন্যতম কারণ।  ১৯৯৯ সালে ভারতকে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করেছিলো উড়িষ্যা রাজ্যের উপকূলবর্তী ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল।
এরপর ভারতীয় সরকার সেটা সংস্কারের ঘোষণা দিলেও তারা সেটা সংস্কার করেনি। ২০০৯ সালে ভারতের স্টেট অফ ফরেস্টে প্রতিবেদন মতে ভারতের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত ম্যানগ্রোভ বন টি ৪৬৩৯ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। 

জানা যায়, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনে ৩৪ প্রজাতির গাছ আছে। এর মধ্যে কেওড়া গাছ সর্বাধিক কার্বন ডাই-অক্সাইড এর শিকড়, কাণ্ড, ডালপালা ও পাতায় আটকে রাখতে পারে। এক হেক্টর কেওড়া বন বছরে ১৭০ টন পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড আটকে রাখতে পারে। বাইনের ক্ষেত্রে তা ১১৫ টন, গেওয়ায় ২৩ টন। গাছের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ওই ক্ষমতা কমতে থাকে।

এখনো পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে মোটামুটি ৬৬২ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড আটকে আছে! এর সঙ্গে প্রতিবছর আরো ৩৮ লাখ টন যোগ হচ্ছে। আটকে থাকা এই বিষ-গ্যাসের একাংশ শর্করায় পরিণত হওয়ায় প্রতিবছর এরা আরো গ্যাস আটকে রাখতে সক্ষম হয়।

এছাড়া বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিবার্তার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এ সুন্দরবন। এত সব উপকারিতা থাকার পরও সুন্দরবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ  কোন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।  দূষণ, দুর্ঘটনা আর বাণিজ্যিক কারণে দেশের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ের একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবনে নোনার মাত্রা বেড়েছে। নদীতে পলিও জমছে অধিক হারে। নদীগুলোর গভীরতা কমছে, ডুবোচর বাড়ছে। সাথে সাথে বেড়ে চলেছে  তেলদূষণ, শব্দদূষণ, আগুন লাগানো, সুন্দরবনের পাশের এলাকায় বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান।

লবণাক্ততা বা নোনা বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, ‘আমাদের মিষ্টি জলের উৎস হচ্ছে পাহাড়বাহিত নদী ও বৃষ্টির পানি। শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়া এবং উজানের নদীগুলো থেকে একেবারেই জল না আসায় এবং একই সঙ্গে জোয়ারের চাপে সাগরের জল বেশি চলে আসায় নোনার আধিক্য ঘটে, যা বৃষ্টি হলেই কমে যায়। উজানের নদীগুলোর জল ভারত নানাভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় আমাদের এখানে মিষ্টি জলের সংকট দেখা দেয়। বছরের বেশির ভাগ সময়ই এখন নোনা জলের দাপট বেশি থাকে। উপরন্তু বনের পশ্চিম অংশে বিদ্যাধরী নদীর মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মিষ্টি জলের জোগান প্রায় বন্ধ। ফলে নুনের তেজ বেড়ে চলেছে। 

সুন্দরী, গরান, গেঁওয়া, কেওড়া এগুলো  ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ। গাছগুলোর দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। একটি হল, এদের শ্বাসমূল থাকে। এদের মূল থেকে একটা ডালের মতো চিকন অংশ মাটি ভেদ করে উঠে আসে। জোয়ারের সময় যখন মাটির উপরে জল জমে যায়, তখনো এই শ্বাসমূলগুলো জলের উপরে ভেসে থাকে। এই শ্বাসমূলগুলোর মাথায় এক ধরনের শ্বাসছিদ্র থাকে, যাদের বলে নিউমাটাপো। এর সাহায্যেই ম্যানগ্রোভ গাছেরা শ্বাস নেয়।সুন্দরী,  গেওয়া, গরান, গোলপাতা, বাইন, কাঁকড়া, হারগোজা, হেতাল প্রভৃতি।

সত্যিকার অর্থে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বলতে যাদের বোঝায় তাদের প্রজাতি সংখ্যা পুরো পৃথিবীতে প্রায় ৫০, যার ৩৫ প্রজাতিই রয়েছে এ সুন্দরবনে। লবণের তারতম্যের ভিত্তিতে বনের বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন উদ্ভিদের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। পৃথিবীর বিখ্যাত বেঙ্গল টাইগারের সবচেয়ে বড় পপুলেশনের প্রাকৃতিক আবাসস্থল এ সুন্দরবন। বাঘ ছাড়াও এখানে রয়েছে  কুমির, চিতল হরিণ, অসংখ্য শূকর, বানরসহ রঙ-বেরঙের অসংখ্য পাখি। প্রায় ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩২০ প্রজাতির পাখি, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর এবং ৪০০ প্রজাতির মাছের আবাসস্থল সুন্দরবন।

জীববৈচিত্র্যের এমন প্রাচুর্যতার জন্য সুন্দরবন ১৯৯২ সালের ২১ মে রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেস্কো সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে। আর এজন্য সুন্দরবনের সৌন্দর্য রক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে বাংলাদেশে ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় সুন্দরবন দিবস।

একদিকে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড়ের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই সুন্দরবন। অন্যদিকে বায়ুমন্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইডকে খাদ্যে রূপান্তরিত করে নোনাজলের এই উদ্ভিদরাজি বেড়ে ওঠে। প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড টেনে নিয়ে কমিয়ে দেয় পরিবেশের দূষণ।

সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ কার্বন শোষণের ক্ষমতা হারাচ্ছে। নির্বিচার গাছপালা কেটে ফেলায় দূষণ বেড়েই চলেছে। ফলে জলের নোনাভাব বেড়ে গিয়ে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার ক্ষমতা হারাচ্ছে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ। ম্যানগ্রোভ, গুল্ম ঘাস, ফাইটোপ্লাঙ্কটন, মোলাস্কাস ক্রমাগত তাদের কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণের স্বাভাবিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। অথচ গাছের শরীরে জমিয়ে রাখা কার্বনকে বলা হয় ব্লু কার্বন। কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণের ফলে কমে উষ্ণায়নের মাত্রা, জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন প্রভাব থেকেও কার্বন রক্ষা করে গাছ। এখনো পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে মোটামুটি ৬৬২ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড আটকে আছে!

ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন নানা রকম প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, নুনের বিষে সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। বাড়ছে তেলদূষণ, শব্দদূষণসহ আরো নানা ধরনের মনুষ্যসৃষ্ট আপদ। সাম্প্রতিক সময়ে নুনের আধিক্য সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভের জন্য ভয়াবহ বিপদের কারণ হয়ে উঠেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এক গবেষনায় বলা হয়, মাটি ও পানিতে নুনের বাড়বাড়ন্তে অনেক প্রজাতির গাছ একেবারেই হচ্ছে না অথবা সাংঘাতিকভাবে এর বৃদ্ধি কমে গেছে।  শুষ্ক মৌসুমে নুনের পরিমাণ বাড়ে সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক গুণ বেশি।

প্রাপ্ত এক তথ্য মতে, পৃথিবীতে প্রায় ১০ কোটি জীববৈচিত্র্য আছে, এর মধ্যে মানুষ প্রায় এক কোটির সন্ধান পেয়েছে। মানুষ কৃষিকাজ ও খাদ্যের জন্য প্রায় ৭ হাজার উদ্ভিদ ও কয়েক হাজার প্রাণীর উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। 
আমাদের এই পরিস্থিতি পার্শ্ববর্তী ওড়িশা রাজ্য থেকে অনেকটাই আলাদা। যেখানে আর কিছু না হোক, উপকূলবর্তী অঞ্চলে ২-৩ কিমি অন্তর আছে একেকটি সাইক্লোন শেল্টার, সেগুলো আসলে প্রধানত বড় বড় পিলারের উপর তৈরি বিশেষ ধরনের বাড়ি যেখানে সাধারণ সময় প্রাইমারি স্কুল চলে, তবে ঝড়ের পূর্বাভাস থাকলেই সেখানে উঠে আসে পুরো গ্রাম আর শুরু হয়ে যায় রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া; পুরোটাই সরকারি খরচে আর ব্যবস্থাপনায় পঞ্চায়েত। অথচ বাম আমলের আয়লা থেকে তৃণমূল আমলের আমপান — সুন্দরবন একই জায়গায় আছে। ওড়িশায় বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রকল্পের টাকায় এসব হয়েছে, সেই প্রকল্প বাম আমলে এ রাজ্যেও শুরু হয়েছিল। তবে সরকারি পয়সায় এলাহি খাওয়া দাওয়া আর বেরানো ছাড়া বিশেষ কিছু হয় নি।

রাজ্য সরকার অবশ্য গোটা রাজ্যের আমপানের ক্ষতি পুনরুদ্ধারে ৬২৫০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। তার মধ্যে যেমন ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে নগদ অর্থ জমা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তেমনি চাষবাস, মৎস্যজীবীদের ক্ষতিপূরণ থেকে পরিকাঠামো পুনর্নিমাণেও জোর দেওয়া হয়েছে। এসবই খুবই আশাব্যঞ্জক ও সদর্থক পদক্ষেপ, যদিও সরকারি পদ্ধতির আর নিয়ম নীতির ফাঁস গলে এই সব টাকা কতটা মানুষের হাতে যাবে, কতটা বিল্ডার, প্রোমোটার, পঞ্চায়েত, এজেন্টদের চক্রে দিকভ্রান্ত হবে সে সব আলোচনা এখানে করব না। তবে এটা জানার আগ্রহ অবশ্যই থাকবে যে হতদরিদ্র মানুষদের জন্য সরাসরি অর্থ ও পেনশনের বন্দোবস্ত করা হচ্ছে তারা সেই টাকা আদৌ পাচ্ছেন কিনা। আশা করি পাবেন। তবে এই লেখার উদ্দেশ্য ত্রাণ, উদ্ধার আর মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের হিসেব নিকেশ করা নয়।

কারণ এটা আপাতত ভালোরকম ভাবেই জানা হয়ে গেছে উত্তর বঙ্গোপসাগর, যা ট্রপিকাল সাইক্লোনের একেবারের ‘টেক্সট বুক’ অঞ্চল বলে বিবেচিত হয়, তার উষ্ণতা এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে এমন ঘূর্ণিঝড় দুর্লভ তো নই-ই, বরং বছরে দুটো করে হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। তার অর্থ হল, এই ক্ষয়ক্ষতি সামলাতে না-সামলাতেই আরেকটা প্রবল ঝড় বা জলোচ্ছ্বাসে ফের সুন্দরবনের মানুষ বিপদগ্রস্ত হতে পারেন, এমনকি সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে পড়তে পারে যাবতীয় কর্মকাণ্ড। না এসব কর্তারা, সাধারণ মানুষ কেউ জানেন না এমন নয়। প্রকৃতপক্ষে এই মাটির বাঁধের নির্মাণ, তার নিয়মিত ভাঙন, ত্রাণ এসবই হল গত পঞ্চাশ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের এক আশ্চর্য সমান্তরাল অর্থনীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার একটা সুযোগ মাত্র, আর একথা সব সুন্দরবন বিশেষজ্ঞই মনে করেন।

প্রায় ১৭০-৭৫ বছর আগে ইংরেজরা সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে ইজারা দেয় আর মেদিনীপুর ও অধুনা বাংলাদেশের যশোর, খুলনা থেকে শয়ে শয়ে ভূমিহীন মানুষ সুন্দরবনে বসত গড়ে তুলতে আসেন। প্রথমেই তাঁরা যেটা করেন সেটা হল, ম্যানগ্রোভ জঙ্গল সাফ করে, যাবতীয় বন্য প্রাণীদের বিতারণ করা আর তারপর ভরা জোয়ার আর কোটালের জল যাতে দ্বীপে দিনে দু’বার ঢুকে পড়ে চাষবাস আর বসবাসের জমি ভাসিয়ে না দেয় তাই নদীর তীর বরাবর বাঁধ তৈরি করা হয়। এটার কারণ যেখানে তাঁরা বসত গড়েছিলেন সেই জায়গাগুলো কোনোদিনই মাটি ফেলে এত উঁচু করা হয়নি বা যায়নি যাতে জোয়ারের জল ঢোকা আটকানো যায়, আর নদীর নোনা জল ঢুকলে তো চাষাবাদ কিছু করা যাবে না, খাওয়ার জল পাওয়া, জীবন কাটানোই মুশকিল হবে। তাই যত দ্বীপে মানুষ বসবাস করতে শুরু করল, ১০২টা  দ্বীপের মধ্যে ৫৪ খানা দ্বীপে এরকমই মাটির দেওয়াল বা বাঁধ দেওয়া হল। আর সেটা করতে গিয়ে আর মানুষের বসতি ও জীবনধারণের বন্দোবস্ত করতে গিয়ে প্রায় পুরোটাই সরিয়ে দেওয়া হল ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। ফল হয়েছে এই স্বাভাবিক জোয়ার ভাটায় পলি আসা যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী জঙ্গল এলাকার তুলনায় এই মানুষের বসবাসকারী দ্বীপগুলো হয়ে গেল আরও নিচু, আর স্বাভাবিক জোয়ার ভাটার বাধা পাওয়ায় নদীখাতেও নানান বদল দেখা দেয়, কোথাও তা পাশের দিকে চওড়া হয়, কোথাও হয় সরু। কিন্তু বছরে ২০ মিলিয়ন টন পলি বহন করে নিয়ে আসছে যে গঙ্গা নদী সেটা এই হুগলি মাতলা মোহনা অঞ্চলে এই ভাবে বাধা প্রানপ্ত হয়ে আঁকাবাকা পথে নদীখাতের নানান অংশে জমতে থাকে, আর তার উল্টোদিকেই জলের তোড়ে বাঁধের মাটি তলা থেকে সরে গিয়ে ভাঙ্গতে থাকে পাড়। এমন করেই গড়ে উঠেছে ৩৫০০ কিমি ব্যাপী এক নদী বাঁধ যা সুন্দরবনের মানুষের জীবন, জীবিকা, রাজনীতি আর অর্থনীতির এক প্রতীক হয়ে উঠেছে।

প্রতি বছর নিয়ম করে নদী বাঁধ মেরামত বাবদ একটা বাজেট ধরা থাকে সরকারের, তা সেচ দপ্তর ও পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বণ্টন করা হয়। গ্রামের লোকেরও কিছু রোজগার হয়, বহু জায়গায় একশোদিনের কাজের সাথেও এটাকে এখন জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে বিষয়টা অতো সহজ নয়, কারণ নদী ও প্রকৃতি কারুর কথা শুনে চলে না। যে বিপুল ম্যানগ্রোভ অরণ্য এই দ্বীপগুলির পাশে পাশে ছিল, জলের কাছ পর্যন্ত, অধিকাংশ জায়গায় তা আর নেই অনেক বছর ধরে, আর ভাঙ্গনের হারও সব জায়গায় সমান নয় যে, কোনোরকমে তাপ্পি মেরে চলে যাবে৷ বহু জায়গায় নদী বাঁধ সাঙ্ঘাতিক ভঙ্গুর অবস্থায় বছরের পর বছর থাকে আর তার পাশেই চরম অনিশ্চিত জীবন কাটাতে থাকেন সুন্দরবনের মানুষ। প্রতি বর্ষা ও ঝড়ের ঋতুতে বাঁধে মাটি ফেলা হয়। কোনোরকমে চলে যায়। যতক্ষণ না একটা আয়লা বা আমপান আসছে।

গত পঞ্চাশ বছরে সুন্দরবনে যত বড় বড় ঝড় হয়েছে তার বেশির ভাগটাই গেছে বাংলাদেশে। তবে তার মধ্যে সুপার সাইক্লোন সিডর আর আয়লা ছিল ভয়াবহ। সিডর মুলত বাংলাদেশের উপকূল ভাগ আর কক্সবাজার অঞ্চলের ভয়ানক ক্ষতি করে, কিন্তু আয়লা ছিল বহু বছরের মধ্যে এমন একটা ঝড় যা ভারতের সুন্দরবনকে মাত্রাহীন বিপর্যয়ে ফেলে। নদীতে জোয়ার থাকায় আয়লায় ভারতীয় সুন্দরবনের ৭৭৮ কিমি নদী বাঁধ ভেঙ্গে যায়। হু হু করে জোয়ারের জল ঢুকে সব চাষের জমি ও মিষ্টি জলের পুকুর ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কৃষিযোগ্য জমি নষ্ট হয়, মানুষের জীবনে নেমে আসে চরম সঙ্কট। ত্রাণ ও উদ্ধার কাজ শেষ হতে না হতে দাবি ওঠে, এইভাবে চলবে না, নদী বাঁধের পাকাপাকি একটা বন্দোবস্ত করতে হবে। এখন সেই বন্দোবস্ত, সেই বিধান রায়ের আমল থেকেই হচ্ছে। হল্যান্ড থেকে বিশেষজ্ঞরা এসেছিলেন, পথও বাতলেছিলেন কিছু, কিন্তু খরচের বহরে সরকার পিছু হটেছিল বছরের পর বছর।  সেবারে কেন্দ্রীয় সরকার আয়লা টাস্কফোর্স গঠন করে সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের বড় বড় আমলা ছিলেন, তাঁদের মদতে ও পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন বিষয়ক ও সেচ দপ্তরের কর্তাদের বুদ্ধিতে একটা ৫০৩২ কোটি টাকার প্রকল্প গঠিত হয়। পরিকল্পনা করা হয় গ্রামের দিকের অধিক জমি অধিগ্রহণ করে শক্ত মাটির ভিতের উপর বেছানো হবে বিশেষ ধরনের পলিপ্রপিলিন শিট আর তার উপর ব্রিক সিমেন্ট পিচিং করে তৈরি করা হবে উঁচু বাধ। সুন্দরবন বিষয়ক সমস্ত বিশেষজ্ঞ এর প্রতিবাদ করেন। বিশেষ করে টেগোর সোসাইটির কর্ণধার তুষার কাঞ্জিলাল, যিনি এই রিকনস্ট্রাকশন কমিটির একজন ইনডিপেনডেন্ট মেম্বার ছিলেন। তাঁদের সকলেরই বক্তব্য ছিল, সুন্দরবনের মতো সদাই গতিশীল মোহনায় এইরকম ইটের বাঁধ বেশিদিন স্থায়ী হবে না, আর সুন্দরবনের মতো জীববৈচিত্র্যপূর্ন অঞ্চলে পলি  প্রপিলিন সিট দিয়ে বাঁধ বানানো চরম ভুল ও অন্যায় কাজ। বরঞ্চ স্বাভাবিক জীববৈচিত্র্য পূর্ণ ঘন ম্যানগ্রোভ অরণ্যের প্রাচীর ও বাঁশের চাটাই দিয়ে অনেক দীর্ঘস্থায়ী বাঁধ বানানো সম্ভব। কিন্তু সে সব কথা কেউ কানে তোলেনি। বেশ কিছু নামকরা কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে কাজের বরাত দেওয়া হয়, যারা কোনোদিন সুন্দরবনের মতো অঞ্চলে কেন কোথাওই কোনও নদী বাঁধ তৈরি করেনি। তারা সুন্দরবনে মাটি কাটার যন্ত্র নিয়ে নেমে পড়লেন বাঁধ বানাতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চরম ব্যর্থতার মুখে পড়ে এই প্রকল্প। প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় জমি। গ্রামের মানুষ কোনোমতেই চাকরি বা বাজার মূল্যে যথেষ্ট মোটা টাকা ছাড়া বাঁধের জন্য জমি দিতে রাজি নয়, সরকার বহু জায়গায় জমির অধিগ্রহণ করতে গিয়ে দেখে জমির সঠিক কোনও মালিক নেই, এই সব নানান বিবাদে সিকি ভাগ কাজ এগোয় না। ততদিনে রাজ্যে বাম আমল বদলে তৃণমূল। জমি জটে কাজ আটকে চলে আসে ২০১৪। ইউপিএ-২ আমলের প্রকল্প তায় আবার অগ্রগতি খুবই খারাপ, মোটামুটি মৃত্যু ঘণ্টা বেজে যায়, আয়লা বাঁধ তৈরি প্রকল্পের। যদিও আমপানের পর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সুন্দরবন বিষয়ক মন্ত্রী বলেছেন, তারা না কি এখনও এই টাকা পাওয়ার আসা রাখেন।

বাদাবনের বিপদ
সুন্দরবনের ১০০০০ বর্গ কিমির বেশির ভাগটা (৬০ শতাংশ) পরে বাংলাদেশে। কিন্তু সেখানকার জনসংখ্যা মাত্র ২০ লক্ষ, আর ভারতের ৪০% ভাগ সুন্দরবনের জনসংখ্যা ৪৫ লক্ষ। বাংলাদেশের সুন্দরবনের একটা বড় সমস্যা হল ট্রপিকাল সাইক্লোনের মুহুর্মুহু আক্রমণ। তার মধ্যে সিডর ২০০৭ সালে যে ধ্বংসলীলা চালায়, তেমনটা আয়লা, আমপান, বুলবুল, ফণি চাক্ষুষ-করা পশ্চিমবঙ্গ দেখেনি। বাংলাদেশের সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভের জৈববৈচিত্র্য অনেক বেশি, সেটার কারণ ক্রমাগত মিষ্টি জলের প্রবাহ, যেটা ভারতের পূর্ব সুন্দরবন, যেখানে আছে প্রজেক্ট টাইগার, সেখানেও (হয়তো ঘনত্ব বেশি) অনেক কম। প্রকৃতপক্ষে ভারতের সুন্দরবনের সপ্তমুখীর পর থেকে মাতলা, বিদ্যাধরী, ঠাকুরান, হরিণভাঙ্গা নদীগুলো পুরোপুরি সমুদ্রের জলে পুষ্ট ও এদের উপরিভাগের মিষ্টি জলের প্রবাহ মনুষ্যকৃত কারণে বুজে গিয়েছে বহুদিন। বহুদিন ধরে এর উপর অনেক গবেষণা হয়েছে এবং উপগ্রহ চিত্র ও অন্যান্য পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যে ভারতীয় সুন্দরবনের একটা বড় অংশ জুড়ে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের এক ভীষণ ক্ষয় হচ্ছে, তার গঠন ও বৃদ্ধি হৃাস পাচ্ছে, তার সবুজের পরিমাণ কমে যাচ্ছে ও গাছগুলো দুর্বল হয়ে গিয়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সাথে লড়ার শক্তি হারিয়ে চলেছে।
 প্রজেক্ট টাইগারের ভিতর বহু এলাকা অপেক্ষাকৃত উঁচু হয়ে তাতে নুনের ভাগ বেড়ে গিয়ে টাকের মতন হয়েছে, যাকে সল্ট ব্ল্যাল্ক বলে, সেখানে কখনও সোয়েডা নামক এক প্রকার নোনা টক শাক ছাড়া কিছুই গজায় না। সুন্দরবনে প্রায় ৭০ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ ও বাদাবনের প্রজাতির গাছ দেখতে পাওয়া যায় আর তার ৩৫টি হল প্রকৃত ম্যানগ্রোভ। এর মধ্যে অন্তত দুটো প্রজাতি এই লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে এ দেশের সুন্দরবন থেকে প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে, আর সে দুটি হল সুন্দরী (হেরিটিয়েরা ফোমিস) ও গোলপাতা (নিপা ফ্রুটিকানস)। অত্যাধিক ভাবে কমে গেছে সবচেয়ে ক্ষয়রোধী গর্জন (রাইজোফোরা), যা মূলত খাড়ির ধারে দেখা যায়। ধুঁধুল, পশুর (জাইলোকারপাস), এমনকি কাঁকড়া (ব্রুগয়রা), গরিয়া (ক্যানডেলিয়া ক্যানডেল)- এর মতো গাছ যথেষ্ট সংখ্যায় আর নেই। গোটা সুন্দরবন জুরে এখন বানি (মূলত এভিসিনিয়া অফিসিনালিস বা সাদা বাইন), গেওয়া (এক্সোকেরিয়া আগালোচা), কিছুটা খর্বকায় গরান (সেরিওপস ডেকানড্রা) আর উঁচু জমিতে হেতাল (ফেলিক্স পেলুডোসা) এর মনোকালচারের মতো পরিস্থিতি প্রায়। আর কেওড়ার (সোনারেসিয়া এপিটালা) প্রজাতিগুলি রয়েছে বিচ্ছিন্ন ভাবে, এর আরেকটি প্রজাতি, ওড়া বা ম্যানগ্রোভ আপেল (সোনেরেসিয়া ক্যাসিওলারিস) পূর্ব সুন্দরবনে খুব কমে গেছে, এবং অপেক্ষাকৃত কম লবণাক্ত অংশ ও পশ্চিম সুন্দরবনেই কিছু আছে।

ম্যানগ্রোভের ক্ষয়ের সাথে সাথে ক্ষয় হয়ে চলেছে সুন্দরবনের আশ্চর্য জৈববৈচিত্র্য, যা বাদা বনের মাটিতে, কাদায় আর জলে থাকে। প্রায় হাজারের উপর অমেরুদণ্ডী প্রাণীর প্রজাতি (এরাই সুন্দরবনের জৈবরাসায়নিক চক্রকে সক্রিয় রাখে, তাই এদের ক্ষয় ম্যানগ্রোভের ক্ষয়ের মতোই চিন্তার বিষয়) এবং ৫০০ প্রকারের মেরুদণ্ডী প্রাণীর বসবাস এই সুন্দরবনে। আর তার মাথা হয়ে আছে বাঘ। শেষ সুমারি অনুযায়ী ভারতীয় সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৯৬। বাঘের সংখ্যা কমলেও বাঘের মানুষকে আক্রমণ করার ঘটনা কমেনি। আর তার কারণ পরিবর্তিত পরিবেশে (যত জল তল বাড়ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে আর এদের শিকার শাকাশি প্রাণীর সংখ্যা কমছে) বাঘের বিচরণ এখন সেই সব দ্বীপেই, যেখানে মাছ, কাঁকড়া আর মধু আহরণে মানুষের আনাগোনা। জঙ্গলের নদীর ধার বরাবর জাল ফেলে গ্রামের দিকে যাওয়া বন্ধ করা গেছে বটে কিন্তু এর ফলে জঙ্গলের ধার ঘেষে মাছ কাঁকড়া ধরার সময় আক্রমণ উল্টে বেড়েছে এমনটাই প্রত্যক্ষদর্শীদের মত। যেটা অবশ্যই বন দপ্তরের কর্তারা মানতে চান না। অবশ্য সে কর্তারা তো জঙ্গলের অধিকার আইনটাই মানতে চান না।

 
 সুন্দরবনকে বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ ঘোষণা করা হয়েছিল। যেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে মানুষ থাকবে মিলেমিশে। কোর এলাকায়, কারুর প্রবেশ নিষেধ, ওখানে প্রজেক্ট টাইগার, যার জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা। তার বাইরে বাফার এলাকায় আছে অভয়ারণ্য, সেখানে মাছ, কাঁকড়া ধরা, মধু আহরণ চলতে পারে। এরও বাইরে থাকবে মানুষের বসবাসের উপযোগী ম্যানিপুলেশন জোন, যেখানে চাষবাস, মৎসচাষ, উদ্যান ও পশুপালন, কুটিরশিল্প চলতে পারে, থাকতে পারে স্কুল, কলেজ, অফিস কাছারি। কোনো ভাবেই এই বায়োস্ফিয়ার অঞ্চলে কোনো ভারি শিল্প, রাসায়নিক শিল্প, সিমেন্ট, কয়লাচালিত বিদ্যুৎ বা কোনো বিপজ্জনক শিল্প হতে পারবে না। কারণ সেটা হলে দূষণ এতো বৃদ্ধি পেতে পারে, যে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য একেবারে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বিষয়টা ভারতের সুন্দরবনের আরও দুটি মর্যাদা যেমন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ও রামসার সাইট তার অপরিপন্থীও বটে।
বাংলাদেশের সুন্দরবনে দুটো রিজার্ভ এলাকা আছে, ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট তকমাও আছে, কিন্তু ভারতের সুন্দরবনের মতো এত সংরক্ষণ ব্যবস্থা বা কড়া আইন নেই।  সেই কারণেই বাংলাদেশের সুন্দরবনের গা ঘেঁষে নানারকম ছোটবড় শিল্প গজিয়ে উঠেছে, যার প্রভাব বনের উপর পড়ছে। এর  সংযোজন হল, রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র যা ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠছে। খুবই স্বাভাবিক যে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র ওই দেশের ও পৃথিবীর যাবতীয় পরিবেশবিদদের চক্ষুশূল হয়েছে, আর তার কারণ সুন্দরবন কোনও দেশের সীমানা বা বেড়া মানে না। বাংলাদেশের রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো প্রকল্পগুলো তাই সুন্দরবনের কফিনে শেষ পেরেক হয়ে দেখা দিতে পারে, সৃষ্টি করতে পারে নয়া প্রাকৃতিক বিপর্যয়। তবে বাঁচার পথ কী?

বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ হওয়ার দরুন সুন্দরবনে কোন ভারি শিল্প হওয়া সম্ভব নয় ওদিকে প্রতি বছর বাঁধ ভেঙে ভেঙে নদীর নোনা জল ঢুকে চাষ আবাদের অবস্থাও তথৈবচ। এমত অবস্থায় সুন্দরবন থেকে আমপান পরবর্তী অবস্থায় বিপুল পরিযায়ী শ্রমিকদের ঢল নামতে পারে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই এমন কিছু করা দরকার যা এই বিপুল মাইগ্রেশনকে, মানুষের এই অবর্ণনীয় কষ্টকে আটকাতে পারে। এমন কিছু জরুরি কথা এখানে আলোচনা করা দরকার।

বাঁধ

আমপান, আয়লার তুলনায় অনেক শক্তিশালী ঝড়, আর তার স্থায়ীত্ব ছিল অনেক বেশি সময় জুড়ে। সমস্ত তথ্য পর্যালোচনা করে যেটা বোঝা যাচ্ছে যে, হয়তো জোয়ার না থাকায় কম বাঁধ ভেঙেছে, তাও আমপানের ক্ষতির ব্যাপকতা কম নয়। মোটের উপর হয়তো আয়লার চেয়ে কম হলেও কোনও কোনও অংশে কম নয় বরঞ্চ বেশি জমিই স্যালিনাইজড হয়েছে। আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম, ইভ্যাকুয়েশন প্রাণ বাঁচিয়ে দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ভবিষ্যতে সুন্দরবনের মানুষের জীবন জীবিকা বাঁচাতে গেলে নদীর তীর ধরে মানুষকে ভিতর দিকে সরিয়ে আনা ছাড়া কোনও পথ নেই। এতে মানুষের চাষের জমি, পুকুর অধিগ্রহণ করতে হলে তাদের অবশ্যই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কতটা সরানো হবে সেটা নির্ভর করবে পরিস্থিতি আর এলাকার উপর, তবে ক্ষেত্র বিশেষে ৫০০-১০০০ মিটার পর্যন্ত সরাতে হতে পারে জনপদকে। এর উদ্দেশ্য হবে, প্রধান নদী বাঁধ বা ডাইকের সামনে একটি বড় ম্যানগ্রোভের অরণ্য তৈরি করা। আর সেটা করতে হবে ম্যানগ্রোভের স্বাভাবিক সাকসেশন বা নদীর কিনারের জোয়ার ভাটা খেলা অঞ্চলের উচ্চতার ভিত্তিতে যে ভাবে ম্যানগ্রোভ জন্মায়, অর্থাৎ ধানীঘাস>বানি>খলসে<>গোলপাতা<>কেওড়া>গর্জন>গরিয়া>কাঁকড়া>ধঁধুল<>পশুর>সুন্দরী> গেওয়া । এটা পরীক্ষিত যে সুসংগঠিত ম্যানগ্রোভ অরন্যের গাছের গুঁড়িগুলো যেমন তীরের দিকে ধাবমান জলের স্রোতের গতিবেগ দারুণ ভাবে কমাতে পারে, তেমন তীব্র ঝড়ের সময় বা ভরা জোয়ারে তার জলের বাইরে বেড়িয়ে থাকা বড় ক্যানোপি গুলো উঁচু উঁচু ঢেউ গুলোকে আটকে দেয়। ভিয়েতনাম ও নেদারল্যান্ডসে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন এমন কোস্টাল ডাইক, যার পিছনে আছে জনপদ, তার সামনে ২০০-৫০০ মিটার এমন লম্বা ম্যানগ্রোভ বন তৈরি করার ফলে ডাইকগুলো অনেক ছোট করলেও চলে, তার উপর বালি, বোল্ডার বা অন্যকিছুর আস্তরণ দেওয়ারও ও দরকার পরে না ফলে খরচও কম হয়।
এটা তৈরি করতে গেলে সব অঞ্চল ও নদীর ধার বরাবর মাটির এমব্যাঙ্কমেন্ট রেখে তিন থেকে চার স্তর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল করা দরকার, আর তার পিছনে থাকবে ডাইক। আর এখানে প্রাধান্য পাবে সল্ট টলারেন্ট ও মাটিকে শক্ত করে ধরে রাখতে পারে এমন প্রজাতি (অবশ্যই ম্যানগ্রোভের ন্যাচারাল সাকসেশন, সেই অঞ্চলের মাটির বৈশিষ্ট্য, ভূপ্রকৃতি, জলের স্রোত, ও উচ্চতার উপর নির্ভর করে প্রজাতি নির্বাচন করতে হবে)। এই পদ্ধতিতে পিছনের বড় ডাইক করার খরচও অনেক কম হবে, কারণ ম্যানগ্রোভের এই অরণ্যই এই বাঁধ ও পিছনের মূল ভূভাগ রক্ষা করবে, ডাইক প্রধানত জল আটকাবে।

এই ভাবে না করা গেলে এই জনপদ কোনওভাবেই রক্ষা করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, এ সবই রিক্লেইমড এরিয়া। ২০০ বছর ধরে মানুষ জঙ্গল কেটে এখানে বসত বানিয়েছে, তাই সরাসরি নদীর ধার বরাবর কোনোরকম মানুষের তৈরি বাঁধ (সে মাটির হোক কি ব্রিক সিমেন্ট পিচিং, জিও জুট, পলি প্রপিলিন, চাটাই বা ভেটিবার ঘাস হোক) এই দ্বীপগুলোকে রক্ষা করতে পারবে না। তবে আজ শুরু হলে নিশ্চিত ভাবে সম্পূর্ণ হতে মিনিমাম ৫-৭ বছর। ততদিন আরও ১৫ টা ছোট বড় ঝড় আসবে। এই কাজ করতে গেলে অর্থ, পরিকল্পনা আর ন্যূনতম কুড়িটা ঝড়ের প্রস্তুতি চাই। তাই সামনের মাটির বাঁধ শক্ত করে বেঁধে তার পিছনে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল শুরু করতে হবে এমন ভাবে যাতে চারাগুলো জল পায় জোয়ারে আবার ভেসেও না যায়। প্রতি বছর এই সামনের নদী বাঁধ মেরামত হবে, যা মূলত ম্যানগ্রোভ চারাকে রক্ষা করছে আর চারার ক্ষয়ক্ষতি মেরামত করতে হবে যতদিন ওই চারা স্বাবলম্বী না হয়। গাছ স্বাবলম্বী হতে হতে পিছনের ডাইক বানিয়ে ফেলতে হবে।

গাছ জ্বলে যাওয়া

আমপানের পর সোশ্যাল মিডিয়া ও সংবাদমাধ্যমে অনেকেই গাছের পাতার জ্বলে যাওয়ার মতো ছবি দেখেছেন। উপকূলবর্তী অঞ্চলে ট্রপিকাল সাইক্লোনের বিপুল হাওয়ার বেগ শুধু সরাসরি ক্ষতি করে বা প্লাবন আনে তাই নয়, বিপুল পরিমাণ সল্ট-স্প্রে আর নুন বহনকারী এরোসল তৈরি করে যা ভূতল থেকে বহু কিমি উপরে উঠে যায় এবং ভূভাগের বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পার। এই প্রকার সল্ট স্প্রে ও ড্রাই এরোসল ভূভাগের ভিতরে গাছের পাতায় অধঃক্ষেপণ হয় ও গাছের পাতা ও মুকুলে নেক্রোসিস তৈরি করে পাতা হলুদ করে দেয়। এরোসল মাটিতে পড়ে এবং গাছের মূলতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে অসমোটিক ইমব্যালেন্স ও ক্লোরাইড টক্সিসিটি তৈরি করার ফলে গাছ শুকিয়ে যেতে থাকে এবং মাটি থেকে নুন অপসারিত না হলে গাছগুলির মৃত্যু ঘটে।

 চেন্নাইয়ের স্বামীনাথন ইন্সটিটিউট এই বিষয়ে একটা খুব জরুরি কাজ করেছে। তারা ভারতের কোস্টাল এলাকার জন্য তীব্র হাওয়া ও সল্ট স্প্রের অভিঘাত সহ্যকারী গাছের একটা সারণি বানিয়েছে, যার মধ্যে নারকেল, ঝাউ সহ অনেকে বৃক্ষ ও স্রাব জাতীয় গাছ আছে। আমাদের সুন্দরবন অঞ্চলে এই ধরনের গাছের প্ল্যান্টেশন তৈরি করা খুব দরকার। 

হাওয়া ও সল্টস্প্রে রোধী গাছ

পরীক্ষায় দেখা গেছে সুন্দরবনের মতো তটবর্তী অঞ্চলে বনসৃজনের সময় ম্যানগ্রোভ ছাড়াও ভুভাগে কিছু বিশেষ ধরনের গাছ লাগানো উচিত, যেমন কাজু গাছ, নিম গাছ, লিপ্সটিক গাছ বা দইগোটা, কাঁটা বাঁশ বা থর্নি ব্যাম্বু, তাল, নারকেল, অমলতাস, ঝাউ, ক্লেরোডেনড্রাম বা ব্লিডিং হার্ট বা ভারাঙ্গি, দেশি তুলা বা সমুদ্রজবা (হিবিসকাস টিলিয়াসিয়াস), ইন্ডিয়ান বিচ ট্রি বা করচ বা করঞ্জ, মিসওয়াক বা পিলু বা টুথব্রাশ ট্রি (সালভাডোরা পারসিকা), রিঠা বা সোপ নাট, পর্শিয়া বা ইন্ডিয়ান টিউলিপ ট্রি, নিশিন্দা। এই সব গাছ নোনা হাওয়া আটকাতে সাহায্য করে এবং ঝড়ের সাথে ভাল ঝুঝতে পারে। ঝাউ ও নারকেলের বনও এই ব্যাপারে খুবই উপযোগী।

বন্যা ও ঝড় নিরোধী চাষ

বিষয়টি নতুন নয়। যেখানে বছর বছর নোনা জল ঢুকে যায় সেখানে আমরা নোনা সহ্যকারী ল্যান্ডরেসগুলো সরিয়ে, উচ্চফলনশীল ধান সুন্দরবন প্রবেশ করিয়েছি, সাথে রাসায়নিক সার ও ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহার। এটা একটা অপরাধ, কারণ এতে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। এখনি সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে এই সব নোনা সহনশীল ধানের চাষ ও বীজের সংরক্ষণ শুরু করা দরকার। এবার আর একটা ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, বোরোধান তুলে মাঠে ও গোলায় রাখা ছিল। তার অনেকাংশই ভিজে কল বেড়িয়ে গেছে। সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চলে কমিউনিটি সাইক্লোন শেল্টার শুধু নয় কমিউনিটি বীজ ও শস্য ভাণ্ডার চাই, যা উঁচু ও পাকা বাড়িতে হওয়া দরকার। যেটা জল ও হাওয়ারোধী।
পৃথিবীর নানান জায়গায় ভাসমান ভেলায় সব্জি, নোনাজল থেকে বিন্দু বিন্দু মিষ্টি জলের সেচের জল বানানোর সহজ ও কম খরচের পদ্ধতি, সোলার মাইক্রোইরিগেশন নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। আসামের মাজুলি দ্বীপ যা বছরে ছয় মাস জলের তলায় থাকে সেখানে এমন ভাসমান সব্জি বাগান সাফল্যের সাথে বানানো হয়েছে। ক্যারিবিয়ানে তো একজন কৃষিবিজ্ঞানী ঝড় নিরোধী চাষ ব্যবস্থা তৈরির পরিকল্পনা করেছেন, যেখানে চাষের জায়গাগুলো ঝড় এলে লুকিয়ে পড়ে, আর তা যদি দিনের বেলায় হয় তবে এলইডি আলো দিয়ে তার সালোকসংশ্লেষ চলে। পাঠক ভাবছেন এসব তো খুব দামি, আমাদের মতো গরিব দেশে তো সম্ভবই নয় ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে যে কোটি কোটি সরকারি ও বেসরকারি অনুদান গোটা সুন্দরবনের জোয়ারের জলে ধুয়ে চলে যায় প্রতিবছর নিয়ম করে, তার কিছুটা পেলেই এরকম শত শত জলবায়ু পরিবর্তন নিরোধী চাষবাসের প্রাথমিক অবকাঠামো তৈরি করা সম্ভব। যে বিপুল ত্রাণ, উদ্ধার ও নবনির্মাণের অর্থ আমপানের পরে প্রবাহিত হচ্ছে, তার ১০% দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে এগুলো তৈরি করা সম্ভব।

পুকুর পুনরুদ্ধার ও মৎস্য চাষ

সুন্দরবনের নানান অঞ্চলে নোনা ও মিষ্টি জলের মাছের চাষ একটা বড় রোজগারের পথ। তবে নোনাজলে মাছ চাষ মূলত বসিরহাট, ন্যাজাট, ভাঙর, হাসনাবাদ, হিঙ্গলগঞ্জে বেশি, কিছুটা কাকদ্বীপ, পাথরপ্রতিমা  ও নামখানা অঞ্চলেও, আর তা মূলত ভেনামি চিংড়ির (আগে ছিল বাগদা) চাষ, সাথে অন্যান্য নোনা জলের মাছ, যেমন পারশে, ভাঙন, ভেটকি যা নদীর জলের সাথে চলে আসে তার ভেড়ি। জায়গায় জায়গায় মিষ্টি জলের রুই, কাতলা, পাবদা, গলদা চিংড়ির চাষ করা হয়। আয়লার মতো আমপানেও নদীর নোনা জল ঢুকে যাওয়ায় মিষ্টি জলের মাছ মারা গেছে। নোনাজলের মাছ জলে ভেসে গেছে। এই সব ভেড়ি বা পুকুরের পাড় খুব নিচু হওয়ায় এবং পাড়ের চারদিকে জাল না থাকায় বা ঝড়ে উড়ে গিয়ে মাছ ভেসে যাওয়া স্বাভাবিক। মাছ ভেসে যাওয়া বা পুকুরে বাইরের জল ঢোকা আটকাতে গেলে পাড় খুব উঁচু করতে হয়, আর তার ধারে জালের বেড়া দিতে হয়, যা জোরালো ঝড়ে না ছিঁড়তে পারে, তাই হালকা করে বেঁধে ভারি বাঁশের ওজন দিয়ে জায়গায় রাখতে হয়।

পুকুরগুলো এই ভাবে তৈরি করালে এই বিপর্যয় হতো না। এখন প্রশ্ন হল আপাতত কী করা যাবে। প্রথমে আসা যাক নোনাজলের মাছ চাষে। ভেনামি চিংড়ি একটি বৈদেশিক প্রজাতি এবং এর চাষের সাথে পরিবেশের সমস্যা, যেমন দূষণ, ম্যানগ্রোভ ধ্বংস ইত্যাদি ও চিংড়ির বড় ব্যবসায়ীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটা কার্টেল তৈরি হয়ে অর্থনৈতিক শোষণের এমন অবস্থা হয়েছে যে আন্তর্জাতিক পরিবেশ নজরদারি সংস্থা গ্রিনপিস একে লাল তালিকাভুক্ত করে দেশে দেশে সুপারমার্কেটে প্রচার চালায়। বাগদা চাষও একই রকম ক্ষতিকারক। এই চাষের জন্যই আরও ম্যানগ্রোভ ধ্বংস হয়েছে। ভারতের নানান রাজ্যে, রাজ্য সরকারগুলো এই চাষ বন্ধ করতে বহুদিন ধরে চেষ্টা করছে। কিন্তু নীতিপঙ্গুতার জন্য পারছে না। এর থেকে বেড়িয়ে আসার একটা ভালো পথ হল, ভাসমান খাঁচায় নোনা কাঁকড়া চাষে বাহবা দেওয়া। কাঁকড়া  চাষ অনেক প্রাকৃতিক ও সহজ এবং এতে ক্ষতি কম। ম্যানগ্রোভ রেখেও করা যায়। শুধু বনদপ্তরের বনের নানান অঞ্চলে মৎস্যজীবীদের ছোট খোসা কাঁকড়া ধরার ইজারা দেওয়া দরকার। বনের অধিকার আইন ব্যবহার করে বাঘ সেনসাসের সময় যেমন সুরক্ষার বন্দোবস্ত করা হয় তেমন ভাবে রোটেশনে এলাকা ভাগ করে করে বনের নানান ব্লকের খাঁড়িতে এই ব্যবস্থা করা যায়। এই খোসা কাঁকড়া ২০-২৫ দিনে ভালো ভারি ও মোটা হয়ে যায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে খুব ভালো দামে বিক্রি হয়, দেশেও বেশ চাহিদা। পরিবেশ কর্মী ও সমাজ কর্মীদের উচিত হবে বনদপ্তরের উপর এই বিষয়ে রাজনৈতিক চাপ তৈরি করা। এটা না হলে বেআইনি কাঁকড়া ধরা চলবে ও বনদপ্তরের অসহযোগিতায় এরা চরম নির্যাতিত হতেই থাকবে। আইনি ব্যবস্থা ও সুরক্ষা বাড়লে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারানো কমবে, আর যদি কখনও এমন দুর্ঘটনা ঘটেও লোকে জীবনবিমার টাকাটা পাবে।

নোনা হয়ে যাওয়া জলে সি উইড বা নোনা শ্যাওলার চাষ খুব লাভজনক হতে পারে। নতুন করে নোনা জল ঢোকানোর দরকার নেই। ম্যানগ্রোভের নিউম্যাটোফোরের গায়ে হয়ে থাকা বেশ কিছু শ্যাওলা যেমন এন্টারোমরফা, উলভা প্রভৃতিকে নোনা পুকুরে দিব্যি চাষ করা যায়। এই শ্যাওলার বিপুল খাদ্য গুণ, উত্তম পশু খাদ্যও বটে এবং নানান ধরনের শিল্প যেমন কনফেকশনারি, বায়োটেকনলজি শিল্পে এর প্রচুর চাহিদা। সুন্দরবনে এমন চাষ করে সফল ভাবে দেখানো হয়েছে।৫ এখন খালি বৃহৎ উদ্যোগের দরকার।

 
সুন্দরবনের আপাতত অল্প লবনাক্ত হয়ে যাওয়া পুকুর গুলোতে ট্যাংরা, গুলশে, তেলাপিয়া এসব মাছ করা যাবে। এসব মাছের চাষ তিন থেকে ছয় মাসে শেষ হয় ও লাভজনক। মিষ্টিজলের মাছ চাষ করতে গেলে পুকুরের নোনাজল ও তলার নোনা কাদা মাটি পাম্প ও স্লাজ পাম্প দিয়ে বার করে, পুকুরে ক্ষারত্ব ও অম্লত্বের প্রকারভেদে জিপসাম বা চুন দিয়ে ট্রিট করে বর্ষার জল ভরতে হবে। পুকুর শুকিয়ে নিলে আরো ভাল হয়। সবক্ষেত্রেই পুকুরের পাড় উঁচু করতে হবে ও এবিষয়ে মৎস্য বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে নিলে ভাল হবে।

মানুষের মাথা গোঁজার জায়গা

ঝড়ে যে বাড়ি ভাঙে তা ভাঙার মতোই। সুন্দরবনে গ্রামীণ গৃহ প্রকল্পের কাজের প্রগতি মোটেই ভালো নয়। সাইক্লোন শেল্টারও কম। তার ফল মানুষ ভুগছে। এই দাবিগুলোও সঠিকভাবে কোনও রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন করছেন না। গৃহনির্মাণের ক্ষেত্রে এখন অনেক কম খরচের পোক্ত ঘর নির্মাণের প্রযুক্তি এসেছে। তার মধ্যে জিপসাম বোর্ড দিয়ে বাঁশকে রিইনফোর্সমেন্টে ব্যবহার করে, তার মধ্যে পরিবেশ বান্ধব সিমেন্ট ঢেলে বা প্রিফেব্রিকেটেড বিল্ডিং ব্লক দিয়ে গৃহনির্মাণ প্রকল্প করা যায়। মোট কথা যা ঝড়ে জলে উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে, যার খরচ কম, পরিবেশ বান্ধব এবং চটপট বানানো যাবে।

পরিশেষে

বিশ্ব-উষ্ণায়নের প্রভাবে সুন্দরবন ও ভারতের উপকূলবর্তী অঞ্চল গভীর সঙ্কটে। এই সব অঞ্চলে প্রচুর গরিব মানুষ থাকেন। প্রতি বছর প্রাকৃতিক বিপর্যয় হবে আর আমরা তাদের ত্রাণ দিতে বেরবো সে তো হতেই পারে। কিন্তু শুধু ত্রাণেই কি কাজ ফুরোবে? আমরা আবার যে যার কাজ করব আর সুন্দরবন পড়ে থাকবে সুন্দরবন





Others News